ACS BANGLA | এ সি এস বাংলা
অন্ধকার লেখাগুচ্ছ -/ hs semester 3 ondhokar lekha guccha

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ -/ hs semester 3 ondhokar lekha guccha

0

 


অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
সেমিস্টার 3
- শ্রীজাত
Ondhokar lekhaguccha srijat



অন্ধকার লেখাগুচ্ছ

1
না, তুমি অক্ষত আছো। আঁচড়ও লাগেনি।
যা হয়েছে, দূর দেশে। পাশের বাড়িতে।
জীবিতের ধর্ম বহু। মৃত এক শ্রেণি।
সেহেতু সুবিধে হয় মাথা গুনে নিতে।
যেসব মাথার কোনও ধড় নেই আর
তাদের কথার দায় কে নেবে তাহলে?
তোমার শহর শান্ত, নিস্পৃহ বাজার
প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেয়, অন্য কথা ব'লে
তুমিও তো অন্য লোক, অন্য কোনও নামে
বেঁচে আছো জুড়ে থাকা ধড়ে ও মাথায়...
জল গড়ায় বহু দূর। রক্ত কিন্তু থামে।
সে কী বলছে? ভুলে যেতে? ডাকছে না তোমায়?
যে এখনও ভেবে দেখছ, পথে নামবে কি না -
আমি তার মনুষ্যত্ব স্বীকার করি না!

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ(২)

ওকে যা যা বলতে দাওনি, আমি বলব সেটা।
আমি যা পারব না, কেউ ঠিক বলে দেবে।
আমরা তো অক্ষরমাত্র, সময়ই প্রণেতা
দেহ গুনে সবটুকু পাবে না হিসেবে।
এ গ্রন্থ বিরাট। তাকে পড়া শুরু করো।
আমরা যে ছিলাম, আছি, থাকব - জেনে নাও।
মৃতদেহ একইসঙ্গে নীরব, মুখরও
না হলে তো জন্মাত না এই কবিতাও।
পাঁচ আঙুল কাটা গেলে দশ আঙুল জাগে
মুঠো হয়ে গেলে তাতে থাকে না বিভেদ
কাকে মারছ তা অন্তত বুঝে নাও আগে -
তোমার আক্রোশ থাকলে তারও আছে জেদ
তুমি যদি বারংবার কোপ মারতে পারো,
ছিন্ন কাঁধে ফের মাথা জন্মাবে আমারও!

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ

মেঘ করে এসেছে এই সমুদ্রের ধারে
বাতাস জীবন্ত শুধু। বাকি সব ক্লীব।
কে দোষী সাব্যস্ত হয়, জলের বিচারে?
বালিতে বিছিয়ে আছে অগনন জিভ...
ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ক্রুশ আর শেকলও -
সে কোন জেরুজালেম? আর এ কোন ঢাকা?
কোনওভাবে যদি তুমি সত্যি কথা বলো,
হিংসা ঠিকই বুঝে নেয় নিজের এলাকা।
সে যেটা বোঝে না, এই সমুদ্র প্রাচীন।
জিভের সমস্ত বাক্য শুষে নিয়ে বালি
জীবন্ত বাতাসে মিশে যাবে একদিন...
কেটে নেওয়া জিভগুলো পড়ে থাকবে খালি।
মৃত্যুরও বলার থাকে কিছু কিছু কথা -
সহজে মরে না কারও বাক-স্বাধীনতা।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ

অমুক বিষয়ে তুমি লিখেছিলে কিছু?
তাহলে এখন কেন প্রতিবাদী এত?
যেখানে সবার মাথা মাটি ছুঁয়ে নিচু,
সেখানে মিথ্যেও কত সহজে বিখ্যাত।
না, লিখিনি। তাহলে কি এখনও লিখব না?
ধর্মের সমীকরণে কাটাব সময়?
ধিক্কারেও দিক দেখাবে পদবি-ভজনা?
যে-ধর্ম এসব বলে, সে আমার নয়।
যে-সত্যির জন্যে আজও প্রাণ দিতে হয় - 
সে হিন্দু না মুসলমান? সে বৌদ্ধ না শিখ?
কারও মাথা উপড়ে যায়, কারও মনে সয়...
কারও মৃত্যুদিন আর কারও বা তারিখ।
হত্যাই হিংসার ধর্ম। এ-কথা জেনেও
যে মৃতের ধর্ম খুঁজছ, মৌলবাদী সে-ও।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ

রাগ তুলে রাখছি আর পড়ে আসছে রোদ...
কার যেন কোথায় কবে এমনি মরে যাওয়া?
গেরস্ত উঠোনে ডাই রান্নার রসদ - 
আনমনে রক্ত দিয়ে নিকিয়েছি দাওয়া
দরগার জমিতে ফোটে মা কালীর জবা
মা মেরির উড়নি বাঁধা গাঁয়ের মসজিদে
এত দূর পৌঁছয় না মিছিল আর সভা
এখানে শাসন করে সোজাসাপটা খিদে।
দিন শেষে দানা চাই। দরজা দিয়ে বসি।
শ্মশানে কাদের ছেলে এনেছে পোড়াতে?
আজ সে-বাড়ি খাওয়া নেই। বাপ-মা উপোসী।
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।
হে জননী, আজও যদি আঁচলে আবৃত,
তোমার সন্তান তবে এমনিতেই মৃত।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ

দুটো রুটি বেশি পাবে। পৈতে খোলো আগে।
মকুব হয়ে যাবে সুদ। তসবি ছেড়ে এসো।
মিলবে না সুবিধে, যদি গির্জা ভাল লাগে।
যেখানে যেমন পারে, শর্ত দেয় দেশও।
গরিব লোকের ধর্ম বিক্রি হয়ে যাওয়া।
এ-হাতে ও-হাতে ঘোরা, খাবার তাগিদে।
বাকিরা চালায় দেশ, পালে লাগে হাওয়া...
যে-কোনও দলের ধর্ম জিইয়ে রাখা খিদে।
এরই মধ্যে তুমি খোঁজো, প্রভুর পা-দুটি?
এরই মধ্যে তুমি পাও, আল্লার ইশারা?
বিশ্বাসে মিলায় খিদে। বিক্রি করলে রুটি।
তাদের শাসাও দেখি, ভাগ করে যারা?
যে-দেশে পেটেই জ্বলে অধিকাংশ চিতা,
সে-দেশে বিশ্বাস পণ্য। ধর্ম বিলাসিতা।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ

যে-রংই মাখাও গালে, রক্ত মনে হয়।
নিশ্চিত তোমারই জাদু, হে লেডি ম্যাকবেথ -
গোটা দেশ বৃন্দাবন, হোলির সময়।
রঙের কুয়াশা থেকে জেগে ওঠে প্রেত।
সে বলে, 'আমাকে নাও উৎসবে এবার।
ঠান্ডা এ-কপাল, এসো, পরাও আবির...'
ভিড়ে তো সমস্ত মুখ মিশে একাকার
রং মেখে ভূত হল ছিন্ন হওয়া শির।
মৃত্যুর পরেও একই তাড়া করে ফেরা -
এ কোনও কাব্যের চেয়ে কম কিছু নয়।
শুনেছি সহজে পথ ছাড়ে না প্রেতেরা?
যে-রক্ত মাখাও গালে, রং মনে হয়।
কুড়িয়ে এনেছি মাথা, ফুলের বদলে -
পলাশ ফোটেনি ভাল এ-বছর দোলে।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ

পদবি লেখে না কেন? আপত্তি সবার।
গায়ে কোনও চিহ্ন নেই, সে-ও এক জ্বালা।
গোপনে আরতি করে? নমাজ ক'বার?
শুধু নামে কিছুতেই হয় না ফয়সালা।
পদবিই যদি আজও শ্রেষ্ঠ পরিচয়,
নাম দিয়ে তবে কেন তৈরি এ-সমাজ?
না-মানলে অনেক কিছু সহ্য করতে হয় -
কোটি দাঙ্গা পার করে বেঁচে আছি আজ।
আমারও ঐতিহ্য আছে, একটু দীর্ঘই।
আমারও আস্তিক রক্ত বহু নামে ঋণী
হয়তো সংখ্যালঘু, কিন্ত ভূমিহীন নই
কবীরকে মনে আছে। মান্টোকে ভুলিনি।
আমাদের ধর্ম বাঁচা। কৃষক বা কবি -
ফলনে চেনায় জাত। লাগে না পদবি।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ

মাথা কেটে রাখা আছে মার্বেল পাথরে।
তাজা রক্ত মিশে যাচ্ছে সরু নর্দমায়...
সামনেই দাঁড়িয়ে আছি থলি হাতে ধ'রে
যখন জীবিত ছিলে, চিনিনি তোমায়।
আজ অতিথি বাড়ি আসবে, খাওয়াব দুপুরে।
হে বিখ্যাত মাংস, তুমি নরম, মিহি তো?
দোকানি শুরুর আগে শান দিচ্ছে ক্ষুরে
দোকানিরা চিরকাল যেরকম দিত...
তোমাকে খবর করে রাঁধব আমরাই।
বড় টুকরো তুলে দেব অতিথির গ্রাসে
যত দূরে থাকি, জেনো, গন্ধ ঠিকই পাই
গোড়া থেকে উপস্থিত ঘটনার পাশে।
আস্তে আস্তে কাটা হচ্ছে গুর্দা, রাং, সিনা...
দাঁড়িয়ে দেখছি যারা, তারা কি খুনি না?

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১০
যদি বলি মূর্তি নয়? সভ্যতার জিন?
যদি বলি ধর্ম নয়? চিন্তাধারাপাত?
বামিয়ানে বুদ্ধ থেকে মস্কোয় লেনিন -
পাথরে হাতুড়ি লাগে। হৃদয়ে আঘাত।
আমরা ধান ফলিয়েছি ইনকায়, মিশরে
আমরাই গেয়েছি গান রোমে, হরপ্পায়
আজও তার স্রোত বইছে রক্তের ভিতরে -
তুমি ভাবো এক আঘাতে সবই ভাঙা যায়?
মূর্তি নয়। ভাবমূর্তি। আমার না। তোমার।
গুঁড়ো হয়ে মিশে যাচ্ছে সভ্যতার জলে...
ধর্ম তো সহিষ্ণু। তুমি অধর্মের সার।
পাথর নীরবই থাকে। চিন্তা কথা বলে।
যত পারো ভেঙে যাও, ধর্মবীর সাজো -
সভ্যতার রক্তস্রোত শেষ হয়নি আজও!

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১১
যখন সমস্ত পথ মিশেছে কবরে
যখন কারওরই চোখে পলক পড়ছে না
যখন গাছেরা নিভছে একটু একটু ক'রে
যখন সূর্যাস্ত লেগে সকলে অচেনা
যখন সবার দরজা বন্ধ শেষমেশ
যখন কথার পিঠে চেপে বসছে ভয়
যখন নদীরা সব ছেড়ে যাচ্ছে দেশ
যখন তোমার মুখ আর তোমার নয়
যখন ঠিকানা ছেড়ে স্বস্তি ভবঘুরে
যখন বিশ্বাস নেই মুঠোর নিভৃতে
যখন হাজার ক্রুশ জেগে উঠছে দূরে
যখন ফারাক শেষ জীবিতে ও মৃতে
তখন নিজের ব'লে কিছু নেই আর
পৃথিবীর সব ক্ষত প্রথমে আমার।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১২
নৌকা এসে ভিড়েছিল বাংলার কিনারে।
সোনালি চুলের যুবা, ফিরিঙ্গি সে লোক
ব্যবসায় থাকে না মন। গান বাঁধতে পারে।
সে-গানে জড়িয়ে থাকে গস্পেল আর শ্লোক।

হিঁদু ঘরে বিয়ে করল, মাটি হল নুন
কৃষ্টে আর খ্রিস্টে সে-ই ঘোচাল তফাত।
তোমরা তার চালাঘরে লাগালে আগুন
তারপর পেরিয়ে গেল ক'সহস্র রাত...

আবার সে ফিরে এল। অন্য রূপে ফেরা।
এখনও মানে না কিছু, গেয়ে যাওয়া কাজ,
সহিষ্ণু হল না তবু ধর্মযাজকেরা
কাল যারা মোড়ল ছিলে, মৌলবাদী আজ।

খেয়াল করোনি শুধু মারার সময় -
অ্যান্টনিরা চিরকালই জাতিস্মর হয়।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১৩
স্বপ্নে দেখি মরুভূমি। রোদে পোড়া বালি।
ক্যাকটাস না। ফুটে আছে গুচ্ছ কাটা-হাত...
মরীচিকা। জল নয়। চমকানো ভোজালি।
হিংসাই এখানে খাদ্য। ধর্ম অজুহাত।
স্বপ্নে দেখি সমুদ্র। সে বিরাট হাঁ খোলে।
দূরে যে-সূর্যাস্ত, সে-ও রক্তে টলোমলো।
ভার নিয়ে কোনওমতে দিন শেষ হলে
মৃতদের সম্প্রদায় খুঁজে দ্যাখে জলও...
এই সমস্ত স্বপ্নে দেখি। ঘুম আসে না আর।
বাতাসকে প্রশ্ন করি - 'কী তবে উপায়?
কোন পথে শান্তি পাব?'... হাওয়া নির্বিকার।
তারপর ধুলো উড়িয়ে সে বলে আমায় -
'আগে সেই বাড়ি থেকে নিয়ে এসো চাল
যে-বাড়িতে কোনও হত্যা হয়নি গতকাল'।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১৪
আবদুল করিম খাঁ-র ধর্ম ছিল গান।
আইনস্টাইনের ধর্ম দিগন্ত পেরনো।
কবীরের ধর্ম ছিল সত্যের বয়ান।
বাতাসের ধর্ম শুধু না-থামা কখনও।
ভ্যান গঘের ধর্ম ছিল উন্মাদনা। আঁকা।
গার্সিয়া লোরকা-র ধর্ম কবিতার জিত।
লেনিনের ধর্ম ছিল নতুন পতাকা।
আগুনের ধর্ম আজও ভস্মের চরিত।
এত এত ধর্ম কিন্তু একই গ্রহে থাকে।
এ-ওকে, সে-তাকে আরও জায়গা করে দেয়।
তবে কেন অন্য পথ ভাবায় তোমাকে?
তোমার ধর্মের পথে কেন অপব্যয়?
যে তোমাকে শিখিয়েছে দখলের কথা -
জেনো সে ধর্মই নয়। প্রাতিষ্ঠানিকতা।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১৫
আজও কারা গোধরায় মৃতদেহ খোঁজে
অযোধ্যায় আজও কারা আগলায় মুষল
একদিন সূর্যাস্ত এত ধারালো ছিল যে
লাল হয়ে গেছিল স্বর্ণমন্দিরের জল।
এ-খেলার শেষ নেই। এরই মধ্যে তুমি
যদি বলে ওঠো "কোনও পক্ষই মানি না",
সাক্ষ্যও দেবে না জেনো প্রিয় জন্মভূমি
অন্তিম মুহূর্তে শুধু উগরে দেবে ঘৃণা।
আমি সেই মাটি থেকে কথা বলতে চাই
যে-মাটিতে এখনও সশস্ত্র নীরবতা ;
অসাধারণের মৃত্যু অনিবার্য, তাই
সাধারণের সহায় অন্যমনস্কতা।
এই উপমহাদেশ আমার ঠিকানা
হত্যাটি অনুমোদিত। কথা বলা মানা।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১৬
বালক যিশুর দেহ শোয়ানো কফিনে
মা মেরি ধর্ষিতা হন সেই একই তারিখে
রক্তের আদিম রেখা রাস্তা চিনে চিনে
রানাঘাট থেকে চলে লাহোরের দিকে।
আকাশে উড়ন্ত ক্রুশ পরিক্রমা করে
এত কিছু দেখেশুনে সে একটু কাহিলও।
খাদক নিশ্চিন্তে ঢোকে নিরীহের ঘরে -
পাহারায় শাসকেরা বরাবরই ছিল।
হে ক্রুশ, কোথায় ছুটবে আজ তোমার মন?
কোন মাটির দাবি বেশি? কার শিয়রে যাবে?
মাঝখানে যে-কাঁটাতার, মুকুট এখন।
ছটফটাচ্ছে উপযুক্ত মাথার অভাবে।
উঁচু একটা টিলা খুঁজে দাঁড়াও আবার -
নীচে শেষ দেখতে পাবে, এই সভ্যতার।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১৭
আকাশ এখনও লাল। সন্ধে, নাকি ভোর?
মানুষ এখনও শুয়ে। ঘুমন্ত, না মৃত?
জল দিয়ে ঘিরে রাখা প্রাচীন শহর...
কিছুটা চোখেরও জল - এমনই কথিত।
শেষ কবে কেঁদেছে তারা? সে কোন নাটকে?
কোন দৃশ্যে ভিজেছিল সবার রুমাল?
খিদে নিয়ে কাঠঠোকরা বসে আছে চোখে...
শোনা যাচ্ছে কাল আর হবে না সকাল।
এইবেলা যে-যার ধর্ম বুঝে নাও, ওঠো !
মরার ও মারার এই শেষতম সুযোগ।
দীর্ঘদিন চলল, কিন্তু কাহিনিটি ছোট -
বাণিজ্য পরম ধর্ম, দেনা বড় রোগ।
তবুও ভুলিনি দ্যাখো, পুরনো প্রথাটি - 
শাইলক বাড়ায় হাত, আমি মাংস কাটি...

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১৮
এ মাথা ছুঁয়েছে ধুলো, গালিবের ভিটে
এ মাথা নামমাত্র দামে লালনের কেনা
এ মাথা নিজেকে খোঁজে ঢোঁড়াই চরিতে
এ মাথা সহজে জেনো নামানো যাবে না।

এ মাথা স্তম্ভিত, চুপ ফেলিনি'র কাছে
এ মাথা শোয়ানো আলি আকবরের পা'য়
এ মাথা রামকিংকর দেখে তবে বাঁচে
এতবার নত, তাই টানটান হাওয়ায়।

এ মাথা কুরআন জানে, পড়েছে গীতাও।
হেঁটেছে বাইবেল থেকে আদি ত্রিপিটক।
এখন, হ্রদের ধারে, বলো তো কী চাও -
কে হে তুমি? ধর্ম, না অধর্মরূপী বক?

অতও নির্লজ্জ নয় মাথার বাসনা
কাটা গেলে যাবে। তবু নোয়াতে পারব না !

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১৯
নিথর বাবার কোনও বিছানার পাশে
উন্মাদ মায়ের সামনে, একটা একটা ক'রে
কিউবা থেকে রাশিয়ায়, নভেম্বর মাসে
সেনা-ফিরে-যাওয়া কোনও প্রাচ্যের শহরে
বুকের বাঁদিক ঘেঁষে, চোখের কালিতে
স্বাধীন কণ্ঠের পথে দমকে দমকে
শেষবার জেগে ওঠা শিরা-ধমনীতে
কবরখানার দিকে ধাবিত সড়কে
পরস্পর লড়ে যাওয়া কলমে- কৃপানে
যে-পথে সবার জন্ম, সে-পথ আরও চিরে
'কিছুই মানি না' - এই বাক্যের প্রয়াণে
ধর্মের লড়াই শেষে বিক্ষত শরীরে
যখন যেখানে যত গোলাপেরা ফোটে -
আমার স্নানের জল লাল হয়ে ওঠে।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
২০
হয় সাদা, নয় কালো। এ ছাড়া বোঝো না।
চরমপন্থার ধ্বনি বেঁধেছ ঘুঙুরে।
ছাইয়ের নীচেই তবু রাখা আছে সোনা -
শুধু খুঁজে নিতে হয় পথে পথে ঘুরে।
তোমরা বানিয়েছ খোপ, লম্বা দাগ টানা
বিরোধ-বিরোধ খেলা, যেন কত রাগ
ওপরে আলাদা। নীচে একই মালিকানা।
শুধু দেখে রাখা, কেউ না-পেরোয় দাগ।
যারা দাঁড়িয়েছে মাঠে, ছোঁয়নি কিনারা
না এ-মাথা, না ও-মাথা, যারা মাঝখানে,
পৃথিবীর সব ধর্মে শ্রেণিশত্রু তারা
ভয় বলে কিছু নেই তাদের অভিধানে।
মতে মিললে চিরসখা, অন্যথায় ফাঁসি -
এ যদি বিশ্বাস হয়, আমি অবিশ্বাসী।


অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
২১
সকালে লেখার চাপ, কাগজ-পত্রিকা
বিকেলে থেরাপি আর ডাক্তার দেখানো
সন্ধের মরুতে দূর স্কচ-মরীচিকা...
কোহেন থাকেন, পাশে মেহেদি হাসানও।
শুক্রবার রাতে আসছে বন্ধুদের দল।
কোথায় বেড়াতে যাওয়া, এবারের শীতে?
মগজে পেতেছে আড়ি সঞ্চয়ের ছল -
যদি কিছু রাখা যেত ফিক্সড ডিপোজিটে...
এরই মধ্যে শব্দগুলো কখনও ভাবালে
গ্রীষ্মের দুপুরে আমরা গণতন্ত্রপ্রেমী
গোটা একটা সভ্যতার পতনের কালে 
ধর্মতলা মোড় থেকে হেঁটে একাডেমি।
বচনে বিপ্লবী আর প্রাণে সুরক্ষিত -
আমাদের অবসাদ প্ল্যাকার্ডজনিত।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
২২
এক মুঠো পৃথিবী, তার আস্ফালন কত !
যে পারছে শাসন করছে যখন তখন
শস্যের পাশের ক্ষেতে দুলে উঠছে ক্ষত...
অথচ পেরোও যদি মাধ্যাকর্ষণ -
একই সঙ্গে সব কিছু নিষ্প্রাণ আর বেঁচে
এক আবর্তে মিশে যাচ্ছে সামান্য-মহৎ
কে জানে কোনদিক থেকে কোথায় চলেছে
নিয়ন্ত্রণহীন এই চেতনার স্রোত...
ভেসে থাকা ধর্ম শুধু। বিদ্যমান থাকা।
আগে ছিল মহা নাস্তি। পরেও কি তাই?
মাঝখানে ঘূর্ণমান সময়ের চাকা
আমরাও ধুলোর মতো ভাসতে ভাসতে যাই...
তুমি কত তুচ্ছ যদি বুঝতে একবার -

লজ্জায় নামিয়ে রাখতে উদ্যত কুঠার।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ [ শ্রীজাত ]
২৩
তোমার বাবার হাতে শান দেওয়া চপার।
তোমার মায়ের দেহ বোমায় সাজানো।
ওরা না-ও ফিরতে পারে। ফেরে অন্ধকার।
সে আনে শাঁখের ধ্বনি। সে আনে আজানও।
দূরে কোন বিস্ফোরণে উড়ে যাচ্ছে লোক
দূরে কার আক্রমণে কাটা পড়ছে গলা
রাতে রূপকথা চায় তোমারও দু'চোখ
সময়ের কাজ তবে রূপকথা বলা।
কে তোমার সঙ্গে ঘোরে, পুজোয় বা ঈদে?
কে স্নান করিয়ে তবে চুল আঁচড়ে দেয়?
এলোমেলো মাথাভর্তি আদরের খিদে...
সিঁথি কেটে ভাগ করা ন্যায় বা অন্যায়।
কী দেব, স্বান্ত্বনা ছাড়া? বেঁচে থাকো প্রাণে।
তফাত কোরো না শুধু শাঁখে ও আজানে।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ 
২৪
না-জেনে ওড়ায় পাতা, এ কেমন ঝড়?
ঘাতক, তোমাকে আমি বহুদিন চিনি।
মাথা কেটে নিয়ে যাও, পড়ে থাক ধড় -
যেটুকু স্বাধীনচিন্তা, জেনো তা স্বাধীনই।
সে ছোটে আলোর মতো। সে বাঁচে বিদ্যুতে।
তাকে দেখা যায় না তবু সে হল দর্শন
তুমি তাকে কোনওদিনও পারবে না ছুঁতে
ধর্মের কৃপাণ হাতে থাকবে যতক্ষণ।
না-বুঝে ঘনিয়ে আসে, এ কেমন শনি?
রায় থেকে রহমান, ছাড় নেই কারও
মেরে যেতে যেতে যেতে বুঝতেই পারোনি -
এরই মাঝে কবে মৃত্যু হয়েছে তোমারও।
এটুকুই অভিশাপ, হে ধর্মের সেনা
মৃতদেহ বয়ে ফিরবে। কবর পাবে না!

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
২৫
প্রথম আজান শুরু। দূর থেকে শোনো।
ফিনকি দিয়ে উঠে আসে প্রতিবেশী ভোর...
যদিও এদিকে ঘুম ভাঙেনি এখনও,
কতদিন ছাড় পাবে, আমার শহর?

আর কতদিন আমি বাস থেকে নেমে
একা হেঁটে বাড়ি ফিরব, সত্যিই জানি না।
হে পৃথিবী, ভেবে দ্যাখো, তোমার হারেমে
মানুষের জন্য কোনও জায়গা আছে কি না।

মুক্ত ভাবনার কোনও দেশ হয় না। তবু
হিংসা ঠিকই টেনে আনে হত্যার সীমানা
কে আজও শাসন করে? কে আমার প্রভু?
মৃত্যু থেকে বড় নয় মৃত্যু-পরোয়ানা।

আজ হয়তো বেঁচে আছি, কাল হয়তো লাশ...
আমি তবু লিখে যাব আমার বিশ্বাস।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ 
২৬
অদ্বিতীয় এই গ্রহ। অসামান্য ভূমি।
ঘূর্ণনে ক্রিয়াটি শূন্য, তবু ঘুরে চলে।
এরই মধ্যে প্রতিক্রিয়া খুঁজে ফেরো তুমি
যে-ধূর্ত সে বরাবরই বিজয়ীর দলে।

এ তবে কেমন যুদ্ধ, এতটা অসম?
এ তবে কেমন শোধ, উগ্র এতখানি?
বাড়িতে ফেরার পথ আজও দীর্ঘতম
পৃথিবীর ব্যর্থতারা আজও অভিমানী।

তুমি ধর্ম মেনেছ ও ভেঙেছ নিজেই।
বিঁধবে বলে বারবার খুঁজেছ পুতুল।
রক্ত ছাড়া এ রোগের উপশম নেই
কিন্তু তুমি শেষ কথা, এ ধারণা ভুল।

রাতে যাকে হত্যা করো, সকালে সে বেঁচে।

কবিতাটির মূলভাব:

শ্রীজাত রচিত "অন্ধকার লেখাগুচ্ছ" কবিতাগুচ্ছের মূল ভাব হল— আধুনিক সমাজে মানুষের ভিতরে ক্রমশ জমে উঠছে এক নিস্তব্ধ অন্ধকার। মানুষ আজ আর প্রতিবাদ করে না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে গলা তোলে না। কবি আমাদের সেই সমাজচিত্র দেখিয়েছেন, যেখানে চারদিকে অবিচার, স্বজনপ্রীতি, অবহেলা, দুর্নীতি, নিপীড়ন চললেও মানুষ শুধু দেখছে, কিন্তু কিছু বলছে না। একসময়ের সংগ্রামী মানুষ আজ নীরব দর্শকে পরিণত হয়েছে। কবির চোখে এই নৈঃশব্দ্যই এক ভয়ানক অন্ধকার, যা আমাদের অস্তিত্বকে গ্রাস করছে।

এই অন্ধকার শুধু বাইরের জগতে নয়, মানুষের মনের ভিতরেও ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের মূল্যবোধ, বিবেক, বোধশক্তি—সব কিছু যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। কবি এই নিরুত্তাপ, আত্মকেন্দ্রিক সমাজকে জাগিয়ে তুলতে চান। তিনি স্পষ্টভাবে বোঝাতে চেয়েছেন, সমাজে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে হলে আগে এই নৈঃশব্দ্য ভাঙতে হবে। মানুষকে সাহসী হতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। কবির প্রত্যাশা—একদিন এই অন্ধকার কেটে যাবে, মানুষ নিজের শক্তিতে আলোর পথে এগিয়ে যাবে, এবং মানবতা পুনরায় প্রতিষ্ঠা পাবে।

Mcq


🌟 প্রশ্ন: “অন্ধকার লেখাগুচ্ছ” কার লেখা?
উত্তর: শ্রীজাতর লেখা।

🌟 প্রশ্ন: কবিতাটিতে মূলত কী নিয়ে কথা বলা হয়েছে?
উত্তর: সমাজে মানুষের নিঃশব্দতা ও ভিতরের অন্ধকার নিয়ে।

🌟 প্রশ্ন: কবি কী ভাঙতে চান?
উত্তর: নৈঃশব্দ্য ভাঙতে চান।

🌟 প্রশ্ন: কবির মতে, সমাজে কী কেটে যাবে?
উত্তর: অন্ধকার কেটে যাবে।

🌟 প্রশ্ন: মানুষের মনের কোন গুণগুলি ঘুমিয়ে পড়েছে বলে কবি মনে করেন?
উত্তর: বিবেক, বোধশক্তি ও মূল্যবোধ।

🌟 প্রশ্ন: কবিতাটিতে মানুষ কীভাবে বর্ণিত হয়েছে?
উত্তর: নীরব দর্শক হিসেবে।

🌟 প্রশ্ন: কবি কী প্রত্যাশা করেন?
উত্তর: মানুষ আলোর পথে এগিয়ে যাবে।

অবশ্যই, নিচে আরও অনেকগুলি এক নম্বর ছোট প্রশ্ন ও উত্তর দিলাম — সহজ ভাষায়, মুখস্থ করার উপযুক্তভাবে:


🌟 প্রশ্ন: কবি শ্রীজাত কোন ধরনের কবিতার জন্য পরিচিত?
উত্তর: আধুনিক ও সমাজসচেতন কবিতার জন্য।

🌟 প্রশ্ন: ‘অন্ধকার’ শব্দটি এখানে কী বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে?
উত্তর: অজ্ঞতা, মৌনতা ও অন্যায়ের প্রতীক হিসেবে।

🌟 প্রশ্ন: ‘নিঃশব্দতা’ কবিতায় কোন অনুভূতির প্রকাশ?
উত্তর: প্রতিবাদহীনতা ও অসহায়তার।

🌟 প্রশ্ন: কবির মতে সমাজে কী নিঃশব্দ হয়ে গেছে?
উত্তর: মানুষের বিবেক ও প্রতিবাদ।

🌟 প্রশ্ন: কবি সমাজের কোন পরিবর্তন চান?
উত্তর: অন্ধকার দূর করে আলোর পথে চলা।

🌟 প্রশ্ন: কবিতায় আলো কী বোঝাতে বলা হয়েছে?
উত্তর: সচেতনতা, প্রতিবাদ ও আশার প্রতীক।

🌟 প্রশ্ন: কবি কাদের ‘নিরব দর্শক’ বলেছেন?
উত্তর: সমাজের সাধারণ মানুষদের।

🌟 প্রশ্ন: কবিতায় অন্ধকার কিসের ইঙ্গিত?
উত্তর: সমাজের অবক্ষয় ও নৈতিক দুর্বলতা।

🌟 প্রশ্ন: কবি সমাজকে কোন দিক থেকে জাগাতে চান?
উত্তর: বিবেক ও প্রতিবাদের মাধ্যমে।

🌟 প্রশ্ন: কবি কীসের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বলেন?
উত্তর: অন্যায় ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে।

🌟 প্রশ্ন: কবি কোন জিনিসটিকে ‘ঘুমিয়ে পড়েছে’ বলে মনে করেন?
উত্তর: মানবতা ও ন্যায়বোধ।

🌟 প্রশ্ন: কবির মতে সমাজে পরিবর্তন আনবে কে?
উত্তর: সচেতন মানুষরাই।

🌟 প্রশ্ন: কবিতাটি কোন ধরনের ভাষায় রচিত?
উত্তর: আধুনিক, গভীর ও প্রতীকী ভাষায়।

🌟 প্রশ্ন: কবি সমাজে আলো কিভাবে আনতে চান?
উত্তর: মানুষের বিবেক জাগিয়ে।



অন্ধকার লেখাগুচ্ছ, শ্রীজাত কবিতা, ক্লাস 12 বাংলা কবিতা, সেমিস্টার 3 বাংলা, বাংলা কবিতা ব্যাখ্যা, মাধ্যমিক বাংলা, শ্রেণি ১২ বাংলা পাঠ, কবিতার প্রশ্নোত্তর, Srijato Class 12



• অন্ধকার লেখাগুচ্ছ কবিতা ব্যাখ্যা

• অন্ধকার লেখাগুচ্ছ ক্লাস ১২

• Srijato poem Andhakar Lekhaguchchha explanation

• শ্রীজাত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

পোস্ট পড়ার পর ভালো লাগলে অবশ্যই কমেন্ট করতে ভুলবেন না ।
( After reading post not forgetting comments. ) 👆

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
"ACSBangla.com: পশ্চিমবঙ্গের স্কুল-কলেজের খবর, বৃত্তি, চাকরি সংক্রান্ত আপডেট, মাধ্যামিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সাজেশন। এছাড়াও এখানে পাবেন পশ্চিমবঙ্গের নতুন প্রকল্পের খবর, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও বাংলার সর্বশেষ সংবাদ। ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপযোগী সাজেশন ও চাকরিপ্রার্থীদের জন্য নিয়মিত আপডেট সহ আরও অনেক কিছু জানতে ভিজিট করুন ACSBangla.com। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা, চাকরি ও প্রজেক্ট সংক্রান্ত আপডেট পেতে থাকুন আমাদের সাথে।" "ACSBangla.com: Get updates on West Bengal school and college news, scholarships, jobs, and exam suggestions for Madhyamik and HS. Also, find information on new projects, important news, and the latest updates from Bengal. Visit ACSBangla.com for student-friendly suggestions and regular updates for job seekers. Stay tuned for updates on education, jobs, and projects in West Bengal." @EnjoyExam @NewsAcsBangla

🔍 সাজেশন, প্রশ্ন বা নোট খুঁজতে এখানে সার্চ করুন:

👉 উদাহরণ: "Class 10 Geography Suggestion 2026", "Class 11 EVS Notes", "2025 Madhyamik Question Paper"