ACS BANGLA | এ সি এস বাংলা
YouTube
সব খবরের আপডেট এতে আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আদরিণী – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় |Adorini | acsbangla.com

আদরিণী – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় |Adorini | acsbangla.com

1

 আদরিণী – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

"আদরিণী" প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি হৃদয়স্পর্শী গল্প, যা উচ্চমাধ্যমিক তৃতীয় সেমিস্টারের বাংলা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। গল্পটি সামাজিক সম্পর্ক, ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগের অনুভূতিগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। লেখক মানব মনের সংবেদনশীলতার সূক্ষ্ম প্রকাশ ঘটিয়েছেন গল্পে।
















আদরিণী – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় |Adorini | acsbangla.com

      প্রথম পরিচ্ছেদ

পাড়ার নগেন ডাক্তার ও জুনিয়ার উকিল কুঞ্জবিহারীবাবু বিকালে পান চিবাইতে চিবাইতে, হাতের ছড়ি দুলাইতে দুলাইতে জয়রাম মোক্তারের নিকট আসিয়া বলিলেন-‘মুখুয্যে মশায়, পীরগঞ্জের বাবুদের বাড়ি থেকে আমরা নিমন্ত্রণ পেয়েছি, এই সোমবার দিন মেজবাবুর মেয়ের বিয়ে। শুনেছি নাকি ভারি ধুমধাম হবে। বেনারস থেকে বাই আসছে, কলকাতা থেকে খেমটা আসছে। আপনি নিমন্ত্রণ পেয়েছেন কি?’

মোক্তার মহাশয় তাঁহার বৈঠকখানার বারান্দায় বেঞ্চিতে বসিয়া হুঁকা নামাইয়া ধরিয়া, একটু উত্তেজিত স্বরে বলিলেন-‘কী রকম? আমি নিমন্ত্রণ পাব না কী রকম?-জানো, আমি আজ বিশ বছর ধরে তাদের এস্টেটের বাঁধা মোক্তার?-আমাকে বাদ দিয়ে তারা তোমাদের নিমন্ত্রণ করবে, এইটে কি সম্ভব মনে করো?’

 

জয়রাম মুখোপাধ্যায়কে ইহারা বেশ চিনিতেন-সকলেই চিনে। অতি অল্প কারণে তাঁহার তীব্র অভিমান উপস্থিত হয়-অথচ হৃদয়খানি স্নেহে, বন্ধু-বাৎসল্যে কুসুমের মতো কোমল, ইহা, যে তাঁহার সঙ্গে কিছুদিনও ব্যবহার করিয়াছে, সেই জানিয়াছে। উকিলবাবু তাড়াতাড়ি বলিলেন-‘না-না-সে কথা নয়- সে কথা নয়। আপনি রাগ করলেন মুখুয্যে মশায়? আমরা কি সে ভাবে বলছি? এ জেলার মধ্যে এমন কে বিষয়ী লোক আছে যে আপনার কাছে উপকৃত নয়- আপনার খাতির না করে? আমাদের জিজ্ঞাসা করবার তাৎপর্য এই ছিল যে, আপনি সে দিন পীরগঞ্জে যাবেন কি?’

 

মুখোপাধ্যায় নরম হইলেন। বলিলেন- ‘ভায়ারা, বসো।’- বলিয়া সম্মুখস্থ আর একখানি বেঞ্চ দেখাইয়া দিলেন। উভয়ে উপবেশন করিলে বলিলেন- ‘পীরগঞ্জে গিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করা আমার পক্ষে একটু কঠিন বটে। সোম মঙ্গল দুটো দিন কাছারি কামাই হয়। অথচ না গেলে তারা ভারি মনে দুঃখিত হবে। তোমরা যাচ্ছ?’

 

নগেন্দ্রবাবু বলিলেন-‘যাবার ত খুবই ইচ্ছে-কিন্তু অতদূর যাওয়া ত সোজা নয়। ঘোড়ার গাড়ির পথ নেই। গোরুর গাড়ি করে যেতে হলে, যেতে দুদিন, আসতে দুদিন। পাল্কি করে যাওয়া-সেও জোগাড় হওয়া মুশকিল। আমরা দুজনে তাই পরামর্শ করলাম, যাই মুখুয্যে মশায়কে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি, তিনি যদি যান, নিশ্চয়ই রাজবাড়ি থেকে একটা হাতিটাতি আনিয়ে নেবেন এখন, আমরা দুজনেও তাঁর সঙ্গে হাতিতে দিব্যি আরামে যেতে পারব।’

 

মোক্তার মহাশয় স্মিতমুখে বলিলেন-‘এই কথা? তার জন্যে আর ভাবনা কি ভাই?-মহারাজ নরেশচন্দ্র তো আমার আজকালের মক্কেল নন-ওঁর বাপের আমল থেকে আমি ওঁদের মোক্তার। আমি কাল সকালেই রাজবাড়িতে চিঠি লিখে পাঠাচ্ছি-সন্ধ্যা নাগাদ হাতি এসে যাবে এখন।’

 

কুঞ্জবাবু বলিলেন-‘দেখলে হে ডাক্তার, আমি ত বলেছিলাম-অত ভাবছ কেন, মুখুয্যে মশায়ের কাছে গেলেই একটা উপায় হয়ে যাবে। তা মুখুয্যে মশায়, আপনাকেও কিন্তু আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। না গেলে ছাড়ছিনে।’

 

‘যাব বৈকি ভায়া-আমিও যাব। তবে আমার ত ভাই খেমটা শোনবার বয়স নেই-তোমরা শুনো। আমি মাথায় এক পগ্‌গ্ন বেঁধে, একটি থেলো হুঁকো হাতে করে, লোকজনের অভ্যর্থনা করব, কে খেলে, কে না খেলে দেখব-তদারক করে বেড়াব। আর তোমরা বসে শুনবে ‘পেয়ালা মুঝে ভর দে’, কেমন?’-বলিয়া মুখোপাধ্যায় মহাশয় হা-হা করিয়া হাসিতে লাগিলেন।

 

           দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

 

পরদিন রবিবার। এ দিন প্রভাতে আহিক পূজাটা মুখখুয্যে মহাশয় একটু ঘটা করিয়াই করিতেন। বেলা ১টার সময় পূজা সমাপন করিয়া জলযোগান্তে বৈঠকখানায় আসিয়া বসিলেন। অনেকগুলি মক্কেল উপস্থিত ছিল; তাহাদের সহিত কথাবার্তা কহিতে লাগিলেন। হঠাৎ সেই হাতির কথা মনে পড়িয়া গেল। তখন কাগজ কলমপইয়া, চশমাটি পরিয়া, ‘প্রবলপ্রতাপান্বিত শ্রীল শ্রীমন্মহারাজ শ্রীনরেশচন্দ্র রায় চৌধুরী বাহাদুর আশ্রিতজনপ্রতিপলোকেষু’ পাঠ লিখিয়া দুই তিন দিনের জন্য একটি সুশীল ও সুবোধ হস্তী প্রার্থনা করিয়া পত্র  লিখিলেন। পূর্বেও আবশ্যক হইলে তিনি কতবার এইরূপে মহারাজের হস্তী আনাইয়া লইয়াছেন। একজন ভৃত্যকে ডাকিয়া পত্রখানি লইয়া যাইতে আজ্ঞা দিয়া, মোক্তার মহাশয় আবার মক্কেলগণের সহিত কথোপকথনে প্রবৃত্ত হইলেন।

 

শ্রীযুক্ত জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের বয়স এখন পঞ্চাশৎ পার হইয়াছে। মানুষটি লম্বা ছাদের-রংটি  আর  একটু পরিষ্কার হইলেই গৌরবর্ণ বলা যাইতে পারিত। গোঁফগুলি মোটা মোটা-কাঁচায় পাকায় মিশ্রিত। মাথার সম্মুখভাগে টাক আছে। চক্ষু দুইটি বড়ো বড়ো, ভাসা ভাসা। তাঁহার হৃদয়ের কোমলতা যেন হৃদয় ছাপাইয়া এই চক্ষু দুইটি দিয়া উছলিয়া পড়িতেছে।

 

ইহার আদি বাস যশোহর জেলায়। এখানে যখন প্রথম মোক্তারি করিতে আসেন, তখন এদিকে রেল খোলে নাই। পদ্মা পার হইয়া কতক নৌকাপথে, কতক গোরুরগাড়িতে, কতক পদব্রজে আসিতে হইয়াছিল। সঙ্গে কেবলমাত্র একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ এবং একটি পিতলের ঘটি ছিল। সহায় সম্পত্তি কিছুই ছিল না। মাসিক তেরো সিকায় একটি বাসা ভাড়া লইয়া, নিজ হাতে রাঁধিয়া খাইয়া মোক্তারি ব্যবসায় আরম্ভ করিয়া দেন। এখন সেই জয়রাম মুখোপাধ্যায় পাকাদালান কোঠা করিয়াছেন, বাগান করিয়াছেন, পুকুর কিনিয়াছেন, অনেকগুলি কোম্পানির কাগজও কিনিয়াছেন। যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন এ জেলায় ইংরাজিওয়ালা মোস্তারের আবির্ভাব হইয়াছে বটে-কিন্তু জয়রাম মুখুয্যেকে তাহারা কেহই হটাইতে পারে নাই। তখনও উনি এ জেলার প্রধান মোক্তার বলিয়া গণ্য।

 

মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের হৃদয়খানি অত্যন্ত কোমল ও স্নেহপ্রবণ হইলেও মেজাজটা কিছু রুক্ষ। যৌবনকালে ইনি রীতিমতো বদরাগী ছিলেন-এখন রক্ত অনেকটা ঠান্ডা হইয়া আসিয়াছে। সেকালে, হাকিমেরা একটু অবিচার অত্যাচার করিলেই মুখুয্যে মহাশয় রাগিয়া চেঁচাইয়া অনর্থপাত করিয়া তুলিতেন। একদিন এজলাসে এক ডেপুটির সহিত ইহার বিলক্ষণ বচসা হইয়া যায়। বিকেলে বাড়ি আসিয়া দেখিলেন, তাঁহার মঙ্গলা গাই একটি এঁড়ে বাছুর প্রসব করিয়াছে। তখন আদর করিয়া উক্ত ডেপুটিবাবুর নামে বাছুরটির নামকরণ করিলেন। ডেপুটিবাবু লোক পরম্পরায় ক্রমে একথা শুনিয়াছিলেন, এবং বলা বাহুল্য নিতান্ত প্রীতিলাভ করেন নাই। আর একবার এক ডেপুটির সম্মুখে মুখুয্যে মহাশয় আইনের তর্ক করিতেছিলেন, কিন্তু হাকিম কিছুতেই ইহার কথায় সায় দিতেছিলেন। না। অবশেষে রাগের মাথায় জয়রাম বলিয়া বসিলেন-‘আমার স্ত্রীর যতটুকু আইন-জ্ঞান আছে, হুজুরের তাও নাই দেখছি।’ সেদিন আদালত অবমাননার জন্য মোক্তার মহাশয়ের পাঁচটাকা জরিমানা হইয়াছিল। এই আদেশের বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্ট অবধি লড়িয়াছিলেন। সবসুদ্ধ ১৭০০ টাকা ব্যয় করিয়া এই পাঁচটি টাকা জরিমানার হুকুম রহিত করিয়াছিলেন।

 

মুখোপাধ্যায় যেমন অনেক টাকা উপার্জন করিতেন, তেমনি তাঁহার ব্যয়ও যথেষ্ট ছিল। তিনি অকাতরে অন্নদান করিতেন। অত্যাচারিত উৎপীড়িত গরিব লোকের মোকর্ণমা তিনি কত সময় বিনা ফিস্-এ, এমন নিজে নিজে অর্থব্যয় পর্যন্ত করিয়া, চালাইয়া দিয়াছেন।

 

প্রতি রবিবার অপরাহ্নকালে পাড়ার যুবক বৃদ্ধগণ মোস্তার মহাশয়ের বৈঠকখানায় সমবেত হইয়া তাস পাশা প্রভৃতি খেলিয়া থাকেন। অদ্যও সেইরূপ অনেকে আগমন করিয়াছেন-পূর্বোক্ত ডাক্তারবাবু ও উকিলবাবু আছেন। হাতিকে বাঁধিবার জন্য বাগানে খানিকটা স্থান পরিষ্কৃত করা হইতেছে, হাতি রাত্রে খাইবে বলিয়া বড়ো বড়ো পাতাসুদ্ধ কয়েকটা কলাগাছ ও অন্যান্য বৃক্ষের ডাল কাটাইয়া রাখা হইতেছে-মোস্তার মহাশয় সে সমস্ত তদারক করিতেছেন। মাঝে মাঝে বৈঠকখানায় আসিয়া, কোনও ব্রাহ্মণের হাত হইতে হুঁকাটি লইয়া দাঁড়াই। দাঁড়াইয়া দুই চারি টান দিয়া আবার বাহির হইয়া যাইতেছেন।

 

সন্ধ্যার কিছু পূর্বে জয়রাম বৈঠকখানায় বসিয়া পাশাখেলা দেখিতে ছিলেন। এমন সময় সেই পত্রবাহক ভৃত্য ফিরিয়া আসিল, বলিল- ‘হাতি পাওয়া গেল না।’

 

কুঞ্জবাবু নিরাশ হইয়া বলিয়া উঠিলেন-‘অ্যাঁ!-পাওয়া গেল না?’

 

নগেন্দ্রবাবু বলিলেন-‘তাই ত! সব মাটি?’

 

মোক্তার মহাশয় বলিলেন-‘কেন রে, হাতি পাওয়া গেল না কেন? চিঠির জবাব এনেছিস?’

 

ভৃত্য বলিল- ‘আজ্ঞে না। দেওয়ানজিকে গিয়ে চিঠি দিলাম। তিনি চিঠি নিয়ে মহারাজের কাছে গেলেন খানিক বাদে ফিরে এসে বললেন, বিয়ের নেমতন্ন হয়েছে তার জন্যে হাতি কেন? গোরুরগাড়িতে আসতে বলো।

 

এই কথা শুনিবামাত্র জয়রাম ক্ষোভে, লজ্জায়, রোষে, যেন একেবারে ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া উঠিলেন। তাঁহার হাত পা ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিল। দুই চক্ষু দিয়া রক্ত ফাটিয়া পড়িতে লাগিল। মুখমণ্ডলের শিরা-উপশিরাগুলি স্ফীত হইয়া উঠিল। কম্পিতস্বরে ঘাড় বাঁকাইয়া বারংবার বলিতে লাগিলেন- ‘হাতি দিলে না! হাতি দিলে না হাতি দিলে না।’

 

সমবেত ভদ্রলোকগণ ক্রীড়া বন্ধ করিয়া হাত গুটাইয়া বসিলেন। কেহ কেহ বলিলেন-‘তার আরি করবেন মুখুয্যে মশায়। পরের জিনিস, জোর তো নেই। একখানা ভালো দেখে গোবুরগাড়ি ভাড়া করে নিয়ে রাত্রি দশটা এগারটার সময় বেরিয়ে পড়ুন, ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবেন। ঐ ইদামদ্দি শেখ একজোড়া নতুন বলদ কিনে এনেছে-খুব দ্রুত যায়।’

 

জয়রাম বক্তার দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া বলিলেন-‘না। গোরুরগাড়িতে চড়ে আমি যাব না। যদি হাি চড়ে যেতে পারি, তবেই যাব, নইলে এ বিবাহে আমার যাওয়াই হবে না।’

 

             তৃতীয় পরিচ্ছেদ

 

শহর হইতে দুই তিন ক্রোশের মধ্যে দুই তিনজন জমিদারের হস্তী ছিল। সেই রাত্রেই জয়রাম তত্তৎ স্থানে লো পাঠাইয়া দিলেন, যদি কেহ হস্তী বিক্রয় করে, তবে কিনিবেন। রাত্রি দুই প্রহরের সময় একজন ফিরিয়া আসি। বলিল-‘বীরপুরের উমাচরণ লাহিড়ীর একটি মাদী হাতি আছে-এখনও বাচ্চা। বিক্রি করবে, কিন্তু বিস্তর দাম চায়।

“কত?”

“দু হাজার টাকা।”

“খুব বাচ্ছা?”

“না, সওয়ারি নিতে পারবে।”

 

“কুছ পরওয়া নেই। তাই কিনব। এখনহ তুমি যাও। কাল সকালেই যেন হাতী আসে। লাহিড়ী মশায়কে আমার নমস্কার জানিয়ে বোলো, হাতীর সঙ্গে যেন কোন বিশ্বাসী কর্মচারী পাঠিয়ে দেন, হাতী দিয়ে টাকা নিয়ে যাবে।”

 

পরদিন বেলা সাতটার সময় হস্তিনী আসিল। তাহার নাম-আদরিণী। লাহিড়ী মহাশয়ের কর্মচারী রীতিমত ষ্ট্যাম্প-কাগজে রসিদ লিখিয়া দিয়া দুই হাজার টাকা লইয়া প্রস্থান করিল।

ব্যবসায়ের প্রতি মুখোপাধ্যায়ের আর যে অনুরাগ নাই-বড় বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছেন। ছোকরা মোক্তারগণ, যাহাদিগকে এক সময় উলঙ্গা-বস্থায় পথে খেলা করিতে দেখিয়াছেন, তাহারা এখন শামলা মাথায় দিয়া (মুখোপাধ্যায় মাথায় পাগড়ী বাঁধিতেন, সেকালে মোক্তারগণ শামলা ব্যবহার করিতেন না) তাঁহার প্রতিপক্ষে দাঁড়াইয়া চোখ মুখ ঘুরাইয়া ফর্ ফর্ করিয়া ইংরাজিতে হাকিমকে কি বলিতে থাকে, তিনি কিছুই বুঝিতে পারেন না।

পার্শ্বস্থিত ইংরাজি জানা জুনিয়রকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘উনি কী বলছেন?’-জুনিয়র তর্জমা করিয়া তাঁহাকে বুঝাইতে বুঝাইতে অন্য প্রসঙ্গ উপস্থিত হয়, মুখের জবাব মুখেই রহিয়া যায়- নিষ্ফল রোষে তিনি ফুলিতে থাকেন। তাহা ছাড়া, পূর্বে হাকিমগণ মুখুয্যে মহাশয়কে যেরূপ শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিতেন, এখনকার নব্য হাকিমগণ আর তাহা করেন না। ইহাদের যেন বিশ্বাস, যে ইংরাজি জানে না সে মনুষ্যপদবাচ্যই নহে; এই সকল কারণে মুখোপাধ্যায় স্থির করিয়াছেন, কর্ম হইতে অবসর গ্রহণ করাই শ্রেয়। তিনি যাহা সঞ্চয় করিয়াছেন, তাহার সুদ হইতে কোনও রকমে সংসার যাত্রা নির্বাহ করিবেন।

 

প্রায় ষাট বৎসর বয়স হইল-চিরকালই কি খাটিবেন? বিশ্রামের সময় কি হয় নাই? বড়ো ছেলেটি যদি মানুষ হইত-দুই টাকা রোজগার করিতে পারিত-তাহা হইলে এতদিন কোন্কালে মুখোপাধ্যায় মহাশয় অবসর লইতেন, বাড়িতে বসিয়া হরিনাম করিতেন। কিন্তু আর বেশি চলে না। তথাপি আজকাল করিয়া আরও এক বৎসর কাটিল।

 

এই সময় দায়রায় একটি খুনি মোকদমা উপস্থিত হইল। সেই মোকর্দমার আসামি জয়রাম মুখোপাধ্যায়কে নিজ মোস্তার নিযুক্ত করিল। একজন নূতন ইংরাজ জজ আসিয়াছেন-তাঁহারই এজলাসে বিচার।

তিন দিন যাবৎ মোকর্দমা চলিল। অবশেষে মোক্তার মহাশয় উঠিয়া ‘জজসাহেব বাহাদুর ও এসেসারী মহোদয়গণ’ বলিয়া বক্তৃতা আরম্ভ করিলেন। বক্তৃতাশেষে এসেসারগণ মুখোপাধ্যায়ের মক্কেলকে নির্দোষ সাবস্ত্য করিলেন-জজসাহেবও তাঁহাদের অভিমত স্বীকার করিয়া আসামিকে অব্যাহতি দিলেন।

 

জজসাহেবকে সেলাম করিয়া, মোস্তার মহাশয় নিজ কাগজপত্র বাঁধিতেছেন, এমন সময় জজসাহেব পেশকারকে জিজ্ঞাসা করিলেন-‘এ উকিলটির নাম কী’।

 

পেশকার বলিল-‘উহার নাম জয়রাম মুখার্জি। উনি উকিল নহেন, মোক্তার।’

 

প্রসন্ন হাস্যের সহিত জজসাহেব জয়রামের প্রতি চাহিয়া বলিলেন-‘আপনি মোক্তার।’

 

জয়রাম বলিলেন-‘হাঁ হুজুর আমি আপনার তাঁবেদার।’

 

জজসাহেব পূর্ববৎ বলিলেন-‘আপনি মোক্তার। আমি মনে করিয়াছিলাম আপনি উকিল? যেরূপ দক্ষতায় সহিত আপনি মোকর্দমা চালাইয়াছেন, আমি ভাবিয়াছিলাম আপনি এখানকার একজন ভালো উকিল।

 

এই কথাগুলি শুনিয়া মুখোপাধ্যায়ের সেই ডাগর চক্ষু দুইটি জলে পূর্ণ হইয়া গেল। হাত দুটি জোড় করিয়া কম্পিতকণ্ঠে বলিলেন-‘না হুজুর; আমি উকিল নহি-আমি একজন মোক্তার মাত্র। তাও সেকালের শিথিল  নিয়মের একজন মূর্খ মোক্তার। আমি ইংরাজি জানি না হুজুর। আপনি আজ আমার যে প্রশংসা করিলেন আমি জীবনের শেষ অবধি তাহা ভুলিতে পারিব না। এই বুড়া ব্রাহ্মণ আশীর্বাদ করিতেছেন, হুজুর হাইকোর্টের জজ হউন।’ বলিয়া ঝুঁকিয়া সেলাম করিয়া মোক্তার মহাশয় এজলাস হইতে বাহির হইয়া আসিলেন।

 

ইহার পর আর তিনি কাছারি যান নাই।

 

           পঞ্চম পরিচ্ছেদ

 

ব্যবসায় ছাড়িয়া কায়ক্লেশে মুখোপাধ্যায়ের সংসার চলিতে লাগিল। ব্যয় যে পরিমাণে সংকোচ করিবেন ভাবিয়াছিলেন, তাহা শত চেষ্টাতেও হইয়া উঠে না। সুদে সংকুলান হয় না, মূলধনে হাত পড়িতে লাগিল কোম্পানির কাগজের সংখ্যা কমিতে লাগিল।

 

একদিন প্রভাতে মোক্তার মহাশয় বৈঠকখানায় বসিয়া নিজের অবস্থার বিষয় চিন্তা করিতেছেন, এমন সময় মাহুত আদরিণীকে লইয়া নদীতে স্নান করাইতে গেল। অনেকদিন হইতেই লোকে ইহাকে বলিতেছিল-‘হাতিটি আর কেন, ওকে বিক্রি করে ফেলুন। মাসে ত্রিশ চল্লিশ টাকা বেঁচে যাবে।’ কিন্তু মুখুজ্যে মহাশয় উত্তর করিয়া থাকেন-‘তার চেয়ে বলো না তোমার এই ছেলেপিলে নাতি-পুতিদের খাওয়াতে অনেক টাকা ব্যয় হয়ে যাচ্ছে-ওদের একে একে বিক্রি করে ফেলো।’ এরূপ উক্তির পর আর কথা চলে না।

 

বাড়ীতে হাতী আসিবামাত্র পাড়ার তাবৎ বালক বালিকা আসিয়া বৈঠকখানার উঠানে ভিড় করিয়া দাঁড়াইল। দুই এক জন অশিষ্ট বালক সুর করিয়া বলিতে লাগিল-“হাতী, তোর গোদা পায়ে নাতি।” বাড়ীর বালকেরা ইহাতে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল এবং অপমান করিয়া তাহা-দিগকে বহিষ্কৃত করিয়া দিল।

 

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“তবে বললেন আমার হাতী?”

 

বিনয় কিংবা শ্লেষসূচক-ঠিক বোঝা গেল না-একটু মৃদু হাস্ত করিয়া জয়রাম বলিলেন- “যখন হুজুর বাহাদুরের দ্বারাই প্রতিপালন হচ্ছি-আমিই যখন আপনার-তখন ও হাতী আপনার বৈ আর কার ?”

 

সন্ধ্যার পর গৃহে ফিরিয়া, বৈঠকখানায় বসিয়া, সমবেত বন্ধুমণ্ডলীর নিকট মুখোপাধ্যায় এই কাহিনী সবিস্তারে বিবৃত করিলেন। হৃদয় হইতে সমস্ত ক্ষোভ ও লজ্জা আজ তাঁহার মুছিয়া গেল। কয়েক দিন পরে আজ তাঁহার সুনিদ্রা হইল।

 

              চতুর্থ পরিচ্ছেদ

 

উল্লিখিত ঘটনার পর সুদীর্ঘ পাঁচটি বৎসর অতীত হইয়াছে-এই পাঁচ বৎসরে মোক্তার মহাশয়ের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হইয়াছে।

 

নূতন নিয়মে পাস করা শিক্ষিত মোক্তারে জেলাকোর্ট ভরিয়া গিয়াছে। শিথিল নিয়মের আইন-ব্যবসায়ীর আর কদর নাই। ক্রমে ক্রমে মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের আয় কমিতে লাগিল। পূব্বে যত উপার্জন করিতেন এখন তাহার অর্দ্ধেক হয় কিনা সন্দেহ। অথচ ব্যয় প্রতি বৎসর বন্ধিতই হইতেছে। তাঁহার তিনটি পুত্র। প্রথম দুইটি মূর্খ-বংশবৃদ্ধি ছাড়া আর কোনও কর্ম্ম করিবার যোগ্য নহে। কনিষ্ঠ পুত্রটি কলিকাতায় পড়িতেছে-সেটি যদি কালক্রমে মানুষ হয় এইমাত্র ভরসা।

 

 

হাতীটিকে দেখিয়া মুখোপাধ্যায়ের মনে হইল, ইহাকে যদি মধ্যে মধ্যে ভাড়া দেওয়া যায়, তাহা হইলে ত কিঞ্চিৎ অর্থাগম হইতে পারে। তখনই কাগজ কলম লইয়া নিম্নলিখিত বিজ্ঞাপনটি মুসাবিদা করিলেন:-

 

                    হস্তী ভাড়ার বিজ্ঞাপন

 

বিবাহের শোভাযাত্রা, দূরদূরান্তে গমনাগমন প্রভৃতি কার্য্যের জন্য নিম্ন সাক্ষরকারীর আদরিণী নাম্নী হস্তিনী ভাড়া দেওয়া হইবে। ভাড়া প্রতি রোজ ৩ টাকা মাত্র, হস্তিনীর খোরাকী ১ টাকা এবং মাহুতের খোরাকি।  একুনে  ধার্য হইয়াছে। যাঁহার আবশ্যক হইবে, নিম্ন ঠিকানায় তত্ত্ব লইবেন।

 

                                                          শ্রীজয়রাম মুখোপাধ্যায় (মোক্তার)

                                                                                               চৌধুরীপাড়া

 

এই বিজ্ঞাপনটি ছাপাইয়া, শহরের প্রত্যেক ল্যাম্পপোষ্টে, পথিপার্শ্বস্থ বৃক্ষকাণ্ডে, এবং অন্যান্য প্রকাশ্য স্থানে আঁটিয়া দেওয়া হইল।

 

বিজ্ঞাপনের ফলে, মাঝে মাঝে লোক হস্তী ভাড়া, লইতে লাগিল বটে-কিন্তু তাহাতে ১৫/২০ টাকার বেশী আয় হইল না।

 

মুখোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পৌত্রটি পীড়িত হইয়া পড়িল। তাহার জন্য ডাক্তার-খরচ, ‘ঔষধ-পথ্যাদির খরচ প্রতিদিন ৫১৭ টাকার কমে নির্ব্বাহ হয় না। মাসখানেক পরে বালকটি কিঞ্চিৎ আরোগ্যলাভকরিল। বড়বধূ মেজবধূ উভয়েই অন্তঃসত্ত্বা। কয়েক মাস পরেই আর দুইটি জীবের অন্নসংস্থান করিতে হইবে।

 

এদিকে জ্যেষ্ঠা পৌত্রী কল্যাণী দ্বাদশবর্ষে পদার্পণ করিয়াছে। দেখিতে দেখিতে যেরূপ ডাগর হইয়া উঠিতেছে, শীঘ্রই তাহার বিবাহ না দিলে নয়। নানাস্থান হইতে তাহার সম্বন্ধ আসিতেছে বটে, কিন্তু ঘর-বর মনের মতন হয় না। যদি ঘর-বর মনের মতন হইল, তবে তাহাদের খাঁই শুনিয়া চক্ষুস্থির হইয়া যায়। কন্যার পিতা এ সম্বন্ধে একেবারেনিলিপ্ত। সে নেশাভাঙ করিয়া, তাস পাশা খেলিয়া, ফুলুট বাজাইয়া বেড়াইতেছে। যত দায় এই ষাট বৎরের বুড়ারই ঘাড়ে।

 

অবশেষে একস্থানে বিবাহ স্থির হইল। পাত্রটি রাজসাহী কলেজে এল-এ পড়িতেছে, খাইবার পরিবার সংস্থানও আছে। তাহারা দুই হাজার টাকা চাহে; নিজেদের খরচ পাঁচ শত-আড়াই হাজার টাকা হইলেই বিবাহটি হয়।

 

কোম্পানীর কাগজের বাণ্ডিল দিন দিন ক্ষীণ হইতেছে-তাহা হইতে আড়াই হাজার বাহির করা বড়ই কষ্টকর হইয়া দাড়াইল। আর, শুধু ত একটি নহে-আরও নাতিনীরা রহিয়াছে। তাহাদের বেলায় কি উপায় হইবে?

 

এই সকল ভাবনা চিন্তার মধ্যে পড়িয়া মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের শরীর ক্রমে ভগ্ন হইয়া পড়িতে লাগিল। একদিন সংবাদ আসিল; কনিজ পত্রটি বি-এ পরীক্ষা দিয়াছিল, সেও ফেল হইয়াছে।

 

বন্ধুগণ বলিতে লাগিলেন- “মুখুয্যে মশায়, হাতীটিকে বিক্রী করে ফেলুন-করে নাতনীর বিবাহ দিন। কি করবেন, বলুন। অবস্থা বুঝে ত কাষ করতে কুয়! আপনি জ্ঞানী লোক, মায়া পরিত্যাগ করুন।”

 

মুখোপাধ্যায় আর কোনও উত্তর দেন না। মাটির পানে চাহিয়া স্নানমুখে বসিয়া কেবল চিন্তা করেন, এবং মাঝে মাঝে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন।

 
চৈত্র সংক্রান্তিতে বামুনহাটে একটি মেলা হয়। সেখানে বিস্তর গরু বাছুর ঘোড়। হাতী উট বিক্রয়ার্থ আসে। বন্ধুগণ বলিলেন-“হাতীটিকে মেলায় পাঠিয়ে দিন, বিক্রী হয়ে যাবে এখন। দু’ হাজারে কিনেছিলেন, এখন হাতী বড় হয়েছে–তিন হাজার টাকা ‘অনায়াসে পেতে পারবেন।”

 

কোঁচার পুঁ’টে চক্ষু মুছিয়া বৃদ্ধ বলিলেন- “কি করে তোমরা এমন কথা বলছ?”

 

বন্ধুরা বুঝাইলেন-“আপনি বলেন, ও আমার মেয়ের মত। তা মেয়েকেই কি চিরদিন ঘরে রাখা যায়? মেয়ের বিয়ে দিতে হয়, মেয়েশ্বশুরবাড়ী চলে যায়, তার আর উপায় কি? তবে পোষা জানোয়ার অনেক দিন ঘরে রয়েছে, মায়া হয়ে গেছে, একটু দেখে শুনে কোনও ভাল লোকের হাতে বিক্রী করলেই হয়। যে বেশ আদর যত্নে রাখবে, কোনও কষ্ট দেবে না-এমন লোককে বিক্রী করবেন।”

 

ভাবিয়া চিন্তিয়া জয়রাম বলিলেন-“তোমরা সবাই যখন বলছ তখন তাই হোক। দাও, মেলায় পাঠিয়ে দাও। একজন ভাল খদ্দের ঠিক কর-তাতে দামে যদি দু-পাঁচশো টাকা কমও হয়, সেও স্বীকার।”

 

মেলাটি চৈত্র-সংক্রান্তির প্রায় পনের দিন পূর্ব্বে আরম্ভ হয়। তবে শেষের চারি পাঁচ দিনই জমজমাট বেশী। সংক্রান্তির এক সপ্তাহ পূব্বে যাত্রা স্থির হইয়াছে। মাহুত ত যাইবেই-মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের মধ্যম পুত্রটিও সঙ্গে যাইবে।

 

যাত্রার দিন অতি প্রত্যুষে মুখোপাধ্যয় গাত্রোত্থান করিলেন। যাই-বার পূর্ব্বে হস্তী ভোজন করিতেছে। বাটীর মেয়েরা, বালকবালিকাগণ সজলনেত্রে বাগানে হস্তীর কাছে দাঁড়াইয়া। খড়ম পায়ে দিয়া মুখো-পাধ্যায় মহাশয়ও সেখানে গিয়া দাঁড়াইলেন। পূর্ব্বদিন দুই টাকার রসগোল্লা আনাইয়া রাখিয়াছিলেন, ভৃত্য সেই হাঁড়ি হাতে করিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। ডালপালা প্রভৃতি মামুলি খাদ্য শেষ হইলে, মুখো-পাধ্যায় মহাশয় স্বহস্তে মুঠা মুঠা করিয়া সেই রসগোল্লা হস্তিনীকে খাওয়াইলেন। শেষে, তাহার গলার নিয়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে ভগ্নকণ্ঠে বলিলেন-“আদর, যাও মা, বামুনহাটের মেলা দেখে এস।”-প্রাণ ধরিয়া বিদায়বাণী উচ্চারণ করিতে পারিলেন না। উদ্বেল দুঃখে, এই ছলনাটুকুর আশ্রয় লইলেন।

 

হাতী চলিয়া গেল। মুখোপাধ্যায় মহাশয় শূন্য মনে বৈঠকখানার ফরাস বিছানার উপর গিয়া লুটাইয়া পড়িলেন। অনেক বেলা হইলে, অনেক সাধ্যসাধনা করিয়া বধূরা তাঁহাকে স্নান করাইলেন। স্নানান্তে আহারে বসিলেন বটে, কিন্তু পাতের অন্ন-ব্যঞ্জন অধিকাংশই অভুক্ত পড়িয়া রহিল।

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

 

কল্যাণীর বিবাহের সমস্ত কথাবার্তা পাকা হইয়া গিয়াছে। ১০ই জ্যৈষ্ঠ শুভকার্য্যের দিনস্থির হইয়াছে। বৈশাখ পড়িলেই উভয় পক্ষের আশীর্ব্বাদ হইবে। হস্তি বিক্রয়ের টাকাটা আসিলেই গহনা গড়াইতে দেওয়া হয়।

 

কিন্তু ১লা বৈশাখ সন্ধ্যাবেল। মস্ মস্ করিয়া আদরিণী ঘরে ফিরিয়া আসিল। বিক্রয় হয় নাই-উপযুক্ত মূল্য দিবার খরিদ্দার জোটে নাই।

 

আদরিণীকে ফিরিতে দেখিয়া বাড়ীতে আনন্দ কোলাহল পড়িয়া গেল। বিক্রয় হয় নাই বলিয়া কাহারও কোনও খেদের চিহ্ন সে সময় দেখা গেল না। যেন হারাধন ফিরিয়া পাওয়া গিয়াছে-সকলের আচরণে এইরূপই মনে হইতে লাগিল।

 

বাড়ীর লোকে বলিতে লাগিল-“আহা, আদর রোগা হয়ে গেছে। বোধ হয় এ ক’দিন সেখানে ভাল করে খেতে পায়নি। ওকে দিন কতক এখন বেশ করে খাওয়াতে হবে।”

 

আনন্দের প্রথম উচ্ছ্বাস অপনীত হইলে, পরদিন সকলের মনে হইল -কল্যাণীর বিবাহের এখন কি উপায় হইবে?

 

প্রতিবেশী বন্ধুগণ আবার বৈঠকখানায় সমবেত হইলেন। অত বড় মেলায় অমন ভাল হাতীর খরিদ্দার কেন জুটিল না, তাহা লইয়া আলোচনা হইতে লাগিল। একজন বলিলেন- “ঐ যে আবার মুখুয্যে মশায় বল্লেন ‘আদর, যাও মা, মেলা দেখে এস’-তাই বিক্রী হল না। উনি ত আর আজকালকার মুর্গীখোর ব্রাহ্মণ নন! ওঁর মুখ দিয়ে যে ব্রহ্মবাক্য বেরিয়েছে, সে কথা কি নিষ্ফল হবার যো আছে! কথায় বলে-ব্রহ্মবাক্য বেদবাক্য।”

 

বামুনহাটের মেলা ভাঙ্গিয়া, সেখান হইতে আরও দশ ক্রোশ উত্তরে রসুলগঞ্জে সপ্তাহব্যাপী আর এক মেলা হয়। যে সকল গো-মহিষাদিবামুনহাটে বিক্রয় হয় নাই-সে সব রসুলগঞ্জে গিয়া জমে। সেইখানেই আদরিণীকে পাঠাইবার পরামর্শ হইল।

 

আজ আবার আদরিণী মেলায় যাইবে। আজ আর বৃদ্ধ তাহার কাছে গিয়া বিদায় সম্ভাষণ করিতে পারিলেন না। রীতিমত আহারাদির পর আদরিণী বাহির হইয়া গেল। কল্যাণী আসিয়া বলিল-“দাদামশায়, আদর যাবার সময় কাঁদছিল।”

 

মুখোপাধ্যায় শুইয়া ছিলেন, উঠিয়া বসিলেন। বলিলেন- “কি বল্লি? কাঁদছিল?”

 

“হ্যাঁ দাদামশায়। যাবার সময় তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল।”

 

বৃদ্ধ আবার ভূমিতে পড়িয়া দীর্ঘনিশ্বাসের সহিত বলিতে লাগিলেন-“জানতে পেরেছে। ওরা অন্তর্যামী কি না! এ বাড়ীতে যে আর ফিরে আসবে না, তা জানতে পেরেছে।”

 

নাতিনী চলিয়া গেলে বৃদ্ধ সাশ্রুনয়নে আপন মনে বলিতে লাগিলেন-“যাবার সময় আমি তোর সঙ্গে দেখাও করলাম না-সে কি তোকে অনাদর করে? না মা, তা নয়। তুই ত অন্তর্যামী-তুই কি আমার মনের কথা বুঝতে পারিস নি?-খুকীর বিয়েটা হয়ে যাক। তার পর, তুই যার ঘরে যাবি, তাদের বাড়ী গিয়ে আমি তোকে দেখে আসব। তোর জন্যে সন্দেশ নিয়ে যাব রসগোল্লা নিয়ে যাব। যতদিন বেঁচে থাকব, মনে কোনও অভিমান করিসনে মা।”

 

সপ্তম পরিচ্ছেদ

 

পরদিন বিকালে একটি চাষীলোক একখানি পত্র আনিয়া মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের হস্তে দিল।

 

পত্র পাঠ করিয়া ব্রাহ্মণের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল। মধ্যমপুত্র লিখিয়াছে ‘বাটা হইতে সাত ক্রোশ দূরে আসিয়া কল্য বিকালে আদরিণী অত্যন্ত পীড়িত হইয়া পড়ে। সে আর পথ চলিতে পারে না। রাস্তার পার্শ্বে একটা আমবাগানে শুইয়া পড়িয়াছে। তাহার পেটে বোধহয় কোনও বেদনা হইয়াছে-শুড়টি উঠাইয়া মাঝে মাঝে কাতরস্বরে আর্তনাদ করিয়া উঠিতেছে। মাহুত যথাবিস্তা সমস্ত রাত্রি চিকিৎসা করিয়াছে-কিন্তু কোনও ফল হয় নাই-বোধ হয় আদরিণী আর বাঁচিবে না। যদি মরিয়া যায় তবে তাহার শবদেহ প্রোথিত করিবার জন্য নিকটেই একটু জমি বন্দোবস্ত লইতে হইবে। সুতরাং কর্তা মহাশয়ের অবিলম্বে আসা আবশ্যক।’

 

বাড়ীর মধ্যে গিয়া উঠানে পাগলের মত পায়চারি করিতে করিতে বৃদ্ধ বলিতে লাগিলেন-“আমার গাড়ীর বন্দোবস্ত করে দাও। আমি এখনি বেরুব। আদরের অসুখ-যাতনায় সে ছটফট করছে। আমাকে না দেখতে পেলে সে সুস্থ হবে না। আমি আর দেরী করতে পারব না।”

 

তখনই ঘোড়ার গাড়ীর বন্দোবস্ত করিতে লোক ছুটিল। রাত্রি দশটার সময় গাড়ী ছাড়িল। জ্যেষ্ঠপুত্রও সঙ্গে গেলেন। পত্রবাহক সেই চাষীলোকটা কোচবাক্সে বসিল।

 

পরদিন প্রভাতে গন্তব্য স্থানে পৌঁছিয়া বৃদ্ধ দেখিলেন-সমস্ত শেষ হইয়া গিয়াছে। আদরিণীর সেই নবজলধরবর্ণ বিশাল দেহখানি আম্রবনের ভিতর পতিত রহিয়াছে-তাহা আজ নিশ্চল-নিস্পন্দ।

 

বৃদ্ধ ছুটিয়া গিয়া হস্তিনীর শবদেহের নিকট লুটাইয়া পড়িয়া, তাহার মুখের নিকট মুখ রাখিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বারম্বার বলিতে লাগিলেন-“অভিমান করে চলে গেলি মা? তোকে বিক্রী করতে পাঠিয়েছিলাম বলে-তুই অভিমান করে চলে গেলি?”

 

ইহার পর দুইটি মাস মাত্র মুখোপাধ্যায় মহাশয় জীবিত ছিলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1মন্তব্যসমূহ

পোস্ট পড়ার পর ভালো লাগলে অবশ্যই কমেন্ট করতে ভুলবেন না ।
( After reading post not forgetting comments. ) 👆

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
"ACSBangla.com: পশ্চিমবঙ্গের স্কুল-কলেজের খবর, বৃত্তি, চাকরি সংক্রান্ত আপডেট, মাধ্যামিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সাজেশন। এছাড়াও এখানে পাবেন পশ্চিমবঙ্গের নতুন প্রকল্পের খবর, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও বাংলার সর্বশেষ সংবাদ। ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপযোগী সাজেশন ও চাকরিপ্রার্থীদের জন্য নিয়মিত আপডেট সহ আরও অনেক কিছু জানতে ভিজিট করুন ACSBangla.com। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা, চাকরি ও প্রজেক্ট সংক্রান্ত আপডেট পেতে থাকুন আমাদের সাথে।" "ACSBangla.com: Get updates on West Bengal school and college news, scholarships, jobs, and exam suggestions for Madhyamik and HS. Also, find information on new projects, important news, and the latest updates from Bengal. Visit ACSBangla.com for student-friendly suggestions and regular updates for job seekers. Stay tuned for updates on education, jobs, and projects in West Bengal." @EnjoyExam @NewsAcsBangla