কেন এল না – সুভাষ মুখোপাধ্যায়
সারাটা দিন ছেলেটা নেচে নেচে বেড়িয়েছে।
রাস্তায় আলো জ্বলছে অনেকক্ষণ এখনও
বাবা কেন এল না, মা?
বলে গেল
মাইনে নিয়ে সকাল- সকাল ফিরবে।
পুজোর যা কেনাকাটা
এইবেলা সেরে ফেলতে হবে।
বলে গেল।
সেই মানুষ এখনও এলো না।
কড়ার গায়ে খুন্তিটা
আজ একটু বেশি রকম নড়ছে।
ফ্যান গালতে গিয়ে
পা-টা পুড়ে গেল।
জানালার দিকে মুখ করে
ছেলেটা বই নিয়ে বসল মাদুরে
সামনে ইতিহাসের পাতা খোলা—
ঘড়িতে টিকটিক শব্দ।
কলে জল পড়ছে।
ও- বাড়ির পাঁচিলটা থেকে লাফিয়ে নামল
একটা গোঁফঅলা বেড়াল।
বাপের- আদরে-মাখা- খাওয়া ছেলের মত
হিজিবিজি অক্ষরগুলো একগুঁয়ে
অবাধ্য–
যতক্ষণ পুজোর জামা কেনা না হচ্ছে
নড়বে না।
এখনও
বাবা কেন এল না, মা?
রান্না কোন্ কালে শেষ
গা ধোয়াও সারা
মা এখন বুনতে বসে
কেবলি ঘর ভুল করছে।
খুট করে একটা শব্দ —
ছিটকিনি খোলার।
কে?
মা, আমি খোকা।
গলির দরজায় ছেলেটা দাঁড়িয়ে।
এখন রেডিওয় খবর বলছে।
মানুষটা এখনও কেন এল না?
একটু এগিয়ে দেখবে বলে
ছেলেটা রাস্তায় পা দিল।
মোড়ে ভিড়;
একটা কালো গাড়ি;
আর খুব বাজি ফুটছে।
কিসের পুজো আজ?
ছেলেটা দেখে আসতে গেল।
তারপর অনেক রাত্তিরে
বারুদের গন্ধে-ভরা রাস্তা দিয়ে
অনেক অলিগলি ঘুরে
মৃত্যুর পাশ কাটিয়ে
বাবা এল।
ছেলে এল না।।
এই কবিতার মূল বিষয়বস্তু হলো — একটি শ্রমজীবী পরিবারের দুঃখময় বাস্তব জীবন ও এক মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি।
পয়েন্ট আকারে সহজভাবে বলা যায় –
🌟 ছেলেটি সারাদিন আনন্দে কাটায়, কারণ সে বাবার ফেরার অপেক্ষায় আছে।
🌟 বাবা সকালে বেরিয়েছিলেন মাইনে আনতে, যাতে পুজোর কেনাকাটা করা যায়।
🌟 দিন গড়িয়ে যায়, রাত হয়, কিন্তু বাবা আর ফেরেন না।
🌟 মা রান্না ও বুনন শেষ করেও উদ্বেগে আছে—“মানুষটা এখনও এল না।”
🌟 হঠাৎ ছেলেটি বাইরে যায়—রাস্তায় ভিড়, বাজি, কালো গাড়ি—একটা ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত।
🌟 শেষে দেখা যায়, অনেক রাতের পর বাবা ফিরে আসে, কিন্তু ছেলেটি আর ফিরে আসে না।
অর্থাৎ, এই কবিতায় সমাজের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জীবনের দুঃখ, অনিশ্চয়তা, দুর্ঘটনা এবং পারিবারিক ভালোবাসার ট্র্যাজিক পরিণতি ফুটে উঠেছে।
শেষে “বাবা এল, ছেলে এল না”—এই বাক্যেই কবিতার গভীর বেদনা ও মানবজীবনের অনিশ্চিত বাস্তবতা প্রকাশ পেয়েছে।
কবিতার প্রতিটি লাইন সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করে দিলাম, যাতে তোমরা সহজে বুঝতে পারো।
(শেষে প্রয়োজনীয় শব্দার্থ আলাদা করে লিখলাম)
১. সারাটা দিন ছেলেটা নেচে নেচে বেড়িয়েছে।
→ সারাদিন ছেলেটি খুব খুশি ছিল, আনন্দে নেচে নেচে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
২. রাস্তায় আলো জ্বলছে অনেকক্ষণ এখনও
→ সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে, অনেক রাত হয়েছে, কিন্তু রাস্তায় এখনও বাতির আলো জ্বলছে।
৩. বাবা কেন এল না, মা?
→ ছেলেটি বারবার মাকে জিজ্ঞেস করছে—“বাবা এখনও ফিরল না কেন?”
৪. বলে গেল মাইনে নিয়ে সকাল- সকাল ফিরবে।
→ সকালে বাবা বেরোনোর সময় বলেছিলেন, বেতন (মাইনে) নিয়ে সকাল সকাল ফিরে আসবেন।
৫. পুজোর যা কেনাকাটা এইবেলা সেরে ফেলতে হবে।
→ পুজোর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার কাজ আজই শেষ করতে হবে—এই কথাটাও বাবা বলেছিলেন।
৬. বলে গেল। সেই মানুষ এখনও এলো না।
→ বাবা কথা দিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু এত রাত হয়ে গেলেও তিনি এখনও ফেরেননি।
৭. কড়ার গায়ে খুন্তিটা আজ একটু বেশি রকম নড়ছে।
→ রান্নার পাত্রে (কড়া) খুন্তি নাড়াতে নাড়াতে মা বুঝছেন তার মন অস্থির হয়ে উঠছে; চিন্তা ও উৎকণ্ঠায় হাত কাঁপছে।
৮. ফ্যান গালতে গিয়ে পা-টা পুড়ে গেল।
→ চুলায় বাতাস দিতে গিয়ে মায়ের পা পুড়ে গেল; মানে চিন্তার কারণে মনোযোগ নেই।
৯. জানালার দিকে মুখ করে ছেলেটা বই নিয়ে বসল মাদুরে
→ ছেলেটি জানালার পাশে মাদুরে বসে বই খুলে পড়ার ভান করছে।
১০. সামনে ইতিহাসের পাতা খোলা—
→ ইতিহাস বই খোলা আছে, কিন্তু মন বইয়ে নেই।
১১. ঘড়িতে টিকটিক শব্দ।
→ ঘড়ির টিকটিক শব্দে বোঝা যায় সময় কেটে যাচ্ছে, তবুও বাবা ফেরেননি।
১২. কলে জল পড়ছে।
→ কল থেকে জল পড়ছে, ঘরের নিস্তব্ধতা বোঝানোর জন্য এই চিত্র।
১৩. ও- বাড়ির পাঁচিলটা থেকে লাফিয়ে নামল একটা গোঁফঅলা বেড়াল।
→ পাশের বাড়ির দেয়াল টপকে একটি গোঁফওয়ালা বিড়াল নিচে নেমে এলো—এ দৃশ্যটি রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশকে আরও জীবন্ত করে তোলে।
১৪. বাপের- আদরে-মাখা- খাওয়া ছেলের মত হিজিবিজি অক্ষরগুলো একগুঁয়ে অবাধ্য–
→ বইয়ের অক্ষরগুলো যেন একগুঁয়ে দুষ্ট ছেলের মতো ছেলেটির চোখে হিজিবিজি হয়ে যাচ্ছে—পড়তে পারছে না।
১৫. যতক্ষণ পুজোর জামা কেনা না হচ্ছে নড়বে না।
→ ছেলেটির মনোযোগ ফিরবে না যতক্ষণ না পুজোর জামা কেনা হচ্ছে, অর্থাৎ সে বাবার অপেক্ষায় আছে।
১৬. এখনও বাবা কেন এল না, মা?
→ আবার ছেলেটি মাকে প্রশ্ন করছে—বাবা এখনো কেন এল না?
১৭. রান্না কোন্ কালে শেষ গা ধোয়াও সারা মা এখন বুনতে বসে কেবলি ঘর ভুল করছে।
→ মা রান্না শেষ করেছেন, গোসলও করেছেন, এখন সুতো বুনছেন—কিন্তু চিন্তায় বারবার ভুল করছেন, মন তার বাবার চিন্তায়।
১৮. খুট করে একটা শব্দ — ছিটকিনি খোলার।
→ হঠাৎ দরজার ছিটকিনির খোলার শব্দ শোনা গেল।
১৯. কে? মা, আমি খোকা।
→ মা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন “কে?”, আর বাইরে থেকে উত্তর এল—“আমি খোকা।”
২০. গলির দরজায় ছেলেটা দাঁড়িয়ে।
→ ছেলেটি তখন গলির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে—বাড়িতে ঢোকার মুহূর্তে।
২১. এখন রেডিওয় খবর বলছে।
→ এ সময় রেডিওতে খবর প্রচার হচ্ছে, অর্থাৎ রাত অনেক হয়েছে।
২২. মানুষটা এখনও কেন এল না?
→ মা ভাবছে—এত রাতেও বাবা ফিরলেন না কেন?
২৩. একটু এগিয়ে দেখবে বলে ছেলেটা রাস্তায় পা দিল।
→ ছেলেটি বাইরে গেল বাবাকে দেখতে, হয়তো কাছাকাছি কোথাও আসছেন।
২৪. মোড়ে ভিড়; একটা কালো গাড়ি; আর খুব বাজি ফুটছে।
→ রাস্তার মোড়ে ভিড়, একটা কালো গাড়ি, চারপাশে বাজির শব্দ—কোনো দুর্ঘটনার বা বিস্ফোরণের ইঙ্গিত।
২৫. কিসের পুজো আজ? ছেলেটা দেখে আসতে গেল।
→ ছেলেটি ভেবেছিল হয়তো কোনো উৎসব হচ্ছে, তাই দেখতে গেল।
২৬. তারপর অনেক রাত্তিরে বারুদের গন্ধে-ভরা রাস্তা দিয়ে অনেক অলিগলি ঘুরে মৃত্যুর পাশ কাটিয়ে বাবা এল।
→ অনেক রাতের পর, যুদ্ধ বা বিস্ফোরণের মতো বারুদের গন্ধমাখা রাস্তায় বিপদ এড়িয়ে বাবা অবশেষে বাড়ি ফিরলেন।
২৭. ছেলে এল না।।
→ কিন্তু তার ছেলে আর ফিরল না। ছেলেটি সেই দুর্ঘটনা বা বিস্ফোরণে মারা গেছে।
শব্দার্থ
১. মাইনে – বেতন
২. খুন্তি – রান্নার কাঠের চামচ
৩. মাদুরে – মাটিতে বিছানো বসার পাটি
৪. হিজিবিজি – গোলমাল, এলোমেলো
৫. অবাধ্য – কথা না শোনা
৬. ছিটকিনি – দরজার ভিতরের তালা
৭. অলিগলি – সরু রাস্তা
৮. বারুদের গন্ধ – বিস্ফোরণ বা ধ্বংসের চিহ্ন
এই কবিতার মাধ্যমে কবি এক শ্রমজীবী পরিবারের আশা, উদ্বেগ, ও অপ্রত্যাশিত ট্র্যাজেডিকে বাস্তব ও মর্মস্পর্শীভাবে প্রকাশ করেছেন।
শেষের লাইন “বাবা এল, ছেলে এল না” – এই এক লাইনেই পুরো কবিতার বেদনা গেঁথে আছে।
পোস্ট পড়ার পর ভালো লাগলে অবশ্যই কমেন্ট করতে ভুলবেন না ।
( After reading post not forgetting comments. ) 👆